আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে স্বপ্নভঙ্গ
প্রকাশ : 2024-03-21 13:58:28১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাঁচ সপ্তাহ পর ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি বারিধারায় মার্কিন দূতাবাসে বেলা আড়াইটা থেকে ৪টা পর্যন্ত বৈঠকে দুজনের মধ্যে কী আলাপ হয়েছে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনায় প্রাধান্য পায়। বৈঠকে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করবে জানতে চেয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। জবাবে ড. মঈন খান জানিয়েছেন, তারা তাদের দাবি আদায় এবং সরকার পতনের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এ বিষয়ে মি. হাস কোনো মন্তব্য করেননি। তবে মার্কিন দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজে বৈঠকের খবর প্রকাশ করে লিখেছে, তারা গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা, সহনশীলতা, সুশাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ওই বৈঠক করে তারা আনন্দিত বলেও দূতাবাস জানিয়েছে। বৈঠক বিএনপিকে কতটুকু আনন্দিত করেছে তা অবশ্য বলা সম্ভব নয়। কেননা বৈঠকের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের আগের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরং একটি ম্রিয়মাণ ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্ভবত বাঁশি হারিয়ে কঞ্চিতে ফুঁ দিয়ে যে লাভ নেই, বিএনপি নেতাকর্মীরা বোধ করি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। দলটির বেশ কয়েকজন নেতা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমাকে বলেছেন, কোন আশায়, কাদের আশ্বাসে তাদের দল এক দফার আন্দোলনের ‘দৃঢ় প্রত্যয়ে’ অনড় থেকে নির্বাচন বর্জন করল, তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। বলা বাহুল্য, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না এবং কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না’ মর্মে বজ্রনির্ঘোষ উচ্চারণের কোনো প্রতিফলন শেষ পর্যন্ত দেখা যায়নি। রাজনীতি অভিজ্ঞ মহল পূর্বাহ্ণেই বলেছিল, বিএনপি হয়তো ‘নিজ বাহুবলে’ নির্বাচন বর্জন করতে পারবে, তবে তা প্রতিহত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। নির্বাচন প্রতিহত করা সংক্রান্ত হুমকি-হুংকার যে অন্তঃসারশূন্য বায়বীয় আস্ফালন ছিল, সময়ে তা প্রমাণিত হয়েছে।
যে প্রশ্নটি এখন সচেতন মহলে আলোচিত হচ্ছে, বিএনপি কি কোনো বিশেষ শক্তির আশ্বাস পেয়ে নির্বাচন বর্জনের মতো অমন একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? এটা আর লুকোছাপার বিষয় নয় যে, সরাসরি আশ্বাস না পেলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকায় তারা সাহসী হয়েছিল। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সে সময়কার তৎপরতা ছিল বিএনপির জন্য ‘সাহসের বড়ি’। যদিও তা ছিল স্পষ্টতই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে তাদের বক্তব্য এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর অঘোষিত চাপ বিএনপিকে উৎসাহিত করেছিল। তবে বিএনপি এক জায়গায় হিসাবে ভুল করেছিল। তাদের বোঝা উচিত ছিল, তারা যদি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বাইরের কোনো শক্তি তাদের সাহায্য করতে পারবে না। কেননা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক একটি সূত্র মেনে চলে। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব সময় বিজয়ীদের পক্ষে অবস্থান নেয়।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, বিএনপির আন্দোলনে সরকারপক্ষ জয়ী হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচনও সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। হয়তো এ নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বিদেশি কোনো কোনো রাষ্ট্র নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে অসন্তুষ্টিও জানিয়েছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং আওয়ামী লীগের পুনরায় সরকার গঠনের পর চিত্র বদলে গেছে। যেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখার কথা বারবার বলেছিল, তারা নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছে। তবে তারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যানও করেনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে তার দেশের প্রশাসন শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাবে বলে জানিয়েছেন। বাইডেনের বিবৃতির পর এ বিষয়ে আর অস্পষ্টতা নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। কেননা যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে একটি বিশেষ দলকে ক্ষমতাসীন করতে প্রকাশ্য ভূমিকা নেবে না।
এরই ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায় ড. মঈন খান ও পিটার হাসের বৈঠকে। খবরে বলা হয়েছে, পিটার হাস জানতে চেয়েছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করবে? বিএনপি তাদের এক দফা ও সরকার পতনের আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে। এ বিষয়ে পিটার হাস কিছু বলেননি। একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির কথা তিনি জানতে চাইতে পারেন, তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারেন না। গণতান্ত্রিক সহনশীলতা বিষয়ে মি. হাস যে কথা বলেছেন, তার বেশি কিছু বলার উপায়ও তার নেই। কারণ কূটনৈতিক শিষ্টাচারের শেকলে তার হাত-পা বাঁধা। মোদ্দা কথা, আন্দোলন চালাকালীন এবং নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও বক্তব্যে বিএনপি উৎসাহিত হলেও এখন আর তা নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রও যে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এরও যে নানা সমীকরণ রয়েছে যাদের সামান্য বোধ আছে তাদের কাছে তা অস্পষ্ট নয়। তাহলে কেন বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় ভরসা করে নির্বাচন বর্জনের মতো একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?
বিএনপির আন্দোলন, নির্বাচন বর্জন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার মধ্যে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কৌতুক-নকশার সাজুয্য দেখা যায়। ভানুবাবু জেনারেল কনসালট্যান্ট হিসেবে ১২ টাকা ফির বিনিময়ে সবাইকে উপদেশ বিতরণ করেন। এক মক্কেল এসে বলল, ‘ভানুবাবু, কোর্টে খোকনের কেস তো খারাপের দিকে যাইতাছে।’ ভানু বললেন, ‘আমার ওপর আস্থা রাখ। এক কাম কর, হাজার পাঁচেক টাকা লইয়া আয়। আমি তো আছি।’ কয়েক দিন পর সেই ব্যক্তি এসে কেঁদেকেটে বলল, ‘খোকনের তো ফাঁসি হইয়া গেল!’ ভানু বললেন, ‘আমার ওপর দেখি তগো কোনো ভরসাই নাই’। হাইকোর্টে আপিল করুম। এমন উকিল ধরুম, প্রতিপক্ষের মুণ্ডু ঘুরাইয়া দিমু। যা আরও হাজার সাতেক টাকা লইয়া আয়।’ কয়েক দিন পর খোকনের ভাই এসে বলল, ‘দাদা, আপিলেও খোকনের ফাঁসির আদেশ বহাল হইয়া গেল।’ ভানু সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘আহ্হা, আমি কি মইরা গেছি? খোকনরে গিয়া ঝুইল্লা পড়তে ক। আমি তো আছি-ই।’ কারও কারও পরামর্শ মানুষকে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে।
সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক