ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের পর তেহরানে ধরপাকড় আর মৃত্যুদণ্ডের ঢেউ!

প্রকাশ : 2025-06-27 10:47:50১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের পর তেহরানে ধরপাকড় আর মৃত্যুদণ্ডের ঢেউ!

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধের পর ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে ব্যাপক হারে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি একাধিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে তেহরান।ইরানি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীতে ইসরায়েলি এজেন্টদের অনুপ্রবেশ ‘নজিরবিহীন’ পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

কর্তৃপক্ষের সন্দেহ, ইসরায়েলকে সরবরাহ করা তথ্যে একাধিক উচ্চপর্যায়ের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের নিশানা করে হত্যা। ইরান দাবি করছে, দেশের ভেতরে সক্রিয় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্যরা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

নিখুঁত পরিকল্পনা করে ইসরায়েল যেভাবে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা আর বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে, তাতে হতবাক ইরানি কর্তৃপক্ষ এখন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করার সন্দেহভাজনদের নিশানা করছে। কারণ হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থের কথা বলা হচ্ছে।

তবে অনেকের আশঙ্কা, এটি বিরোধী কণ্ঠ দমন ও জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও শক্ত করার একটি উপায়।১২ দিনের এই সংঘাতের সময় ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরান তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। যুদ্ধবিরতির একদিন পর বুধবার আরও তিনজনকে একই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এরই মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দেশজুড়ে শতাধিক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারের কথিত স্বীকারোক্তি প্রচার করা হয়েছে, যেখানে তারা ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ কথা বলেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা ও কর্মীরা ইরানের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, ইরান দীর্ঘদিন ধরে ‘জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়’ এবং ‘অন্যায্য বিচার প্রক্রিয়া’ চালিয়ে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও বেশি সংখ্যক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তারা সিআইএ, মোসাদ ও এমআই৬-সহ পশ্চিমা ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ‘অবিরাম যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী সংশ্লিষ্ট ফার্স নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৩ জুন ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে ইরানের ভেতরে ‘ইসরায়েলি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে’। ১২ দিনের সংঘাতে ইরানের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৭০০ জনের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।

বিবিসি ফার্সিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিছু ইরানি নাগরিক জানিয়েছেন, তারা ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কতা এসএমএস পেয়েছেন। বার্তায় বলা হয়েছে, তাদের মোবাইলে ইসরায়েল সম্পর্কিত সোশাল মিডিয়া পেইজে পাওয়া গেছে। তাদের এসব পেইজ ত্যাগ করতে বলা হয়েছে, নয়ত মামলা ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

ইরান সরকার বিদেশে অবস্থিত ফার্সি ভাষার মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সাংবাদিকদের ওপর চাপ বাড়িয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিবিসি ফার্সি, লন্ডনভিত্তিক ইরান ইন্টারন্যাশনাল ও মানোটা টিভি।

ইরান ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চ্যানেলটির একজন উপস্থাপিকার মা, বাবা ও ভাইকে তেহরানে বিপ্লবী বাহিনী আটক করেছে, যাতে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে চ্যানেলের প্রতিবেদনের কারণে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে উপস্থাপিকার বাবা তাকে ফোন করে পদত্যাগ করতে বলেন এবং ভবিষ্যতে তাদের আরও কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিবিসি ফার্সির সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের প্রতি হুমকি মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ভুক্তভোগী সাংবাদিকদের ভাষ্য, ইরানি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছে, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করা ন্যায়সঙ্গত। তারা সাংবাদিকদের ‘মোহারেব’ (যে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে) আখ্যা দিয়েছে, ইরানি আইনে যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

মানোটো টিভিও একই ধরনের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন করেছে, যেখানে কর্মীদের পরিবারকে হুমকি এবং টেলিভিশন স্টোশনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকির কথা উঠে এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে ‘সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে শত্রুতা’ ও ‘গুপ্তচরবৃত্তি’র মত অভিযোগ তুলে স্বজনদের হুমকি দেওয়া হয়েছে- দুটি অভিযোগই ইরানে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ধরনের তৎপরতা একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ, যার উদ্দেশ্য হলো ভিন্নমত দমন ও প্রবাসী সংবাদকর্মীদের ভয় দেখানো।

বিবিসি লিখেছে, নিরাপত্তা বাহিনী বহু লেখক, শিল্পী ও অধিকারকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে- অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনকি ২০২২ সালের ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের নিশানা করে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়েছে।

এসব পদক্ষেপ থেকে বোঝা যাচ্ছে, সরকার কেবল এখনকার অধিকারকর্মীদের নয়, আগের প্রতিবাদে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গেও কঠোর আচরণ করছে।

যুদ্ধ চলার মধ্যে ইরানি সরকার ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করে, এমনকি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও ইন্টারনেট আগের অবস্থায় ফেরেনি। সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট সীমিত করা ইরানের সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, এক্স, ইউটিউবসহ বেশিরভাগ সোশাল মিডিয়া এবং বিবিসি ফার্সির মত নিউজ ওয়েবসাইট দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে ‘ব্লক’ করা আছে, সেগুলো দেখার একমাত্র উপায় ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন।

বিবিসি লিখেছে, মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে ১৯৮০-এর দশকের মিল খুঁজে পাচ্ছেন, যখন ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করে ইরানি কর্তৃপক্ষ।

অনেকেরই আশঙ্কা, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের পর আন্তর্জাতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ার পর ইরান সরকার দেশের অভ্যন্তরে নজর দেবে- ব্যাপক গ্রেপ্তার, মৃত্যুদণ্ড এবং কঠোর দমন-পীড়নের আশ্রয় নেবে।

সমালোচকরা ১৯৮৮ সালের ঘটনা তুলে ধরছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বর্ণনা অনুযায়ী, তখন ‘মৃত্যুদণ্ড কমিশন’র গোপন বিচারে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে দ্রুত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যাদের অনেকে আগেই সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। বেশিরভাগ মৃতদেহ গণকবরে দাফন করা হয়।