প্রশ্নফাঁস-শিক্ষক সিন্ডিকেটে ডুবতে বসেছে কলেজিয়েট স্কুল
প্রকাশ : 2025-06-30 12:13:58১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। রাজধানীর নামি এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। কিন্তু প্রশ্নফাঁস, ব্যাচভিত্তিক প্রাইভেট পড়ানো, কিছু শিক্ষকের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটে ১৯০ বছরের নামকরা প্রতিষ্ঠানটি ডুবতে বসেছে।
বছরের পর বছর একই স্কুলে পদায়ন নিয়ে কিছু শিক্ষক গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা ভাগাভাগি করে ব্যাচভিত্তিক প্রাইভেট পড়ান। নিজের ব্যাচে পড়া শিক্ষার্থীদের হাতে পরীক্ষার আগেই তুলে দেন প্রশ্ন, যা সর্বনাশ ডেকে আনছে শিক্ষার্থীদের জন্য। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরাও।
অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ব্যাচভিত্তিক প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করছেন। তাদের কাছে না পড়া শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন আসে না। আবার পরীক্ষার খাতায়ও নম্বর কম দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা স্কুলের শিক্ষকদের কাছে সন্তানকে প্রাইভেট পড়তে পাঠাচ্ছেন।
তবে এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুল্লাহ খান। তার ভাষ্য, ‘বিষয়গুলো আমি সেভাবে জানি না। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অর্ধবার্ষিকের প্রশ্নফাঁস
কলেজিয়েট স্কুলে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে গত ২৪ জুন। ১০ জুলাই পর্যন্ত এ পরীক্ষা চলবে। প্রথম দিনে চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষাতে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। পরীক্ষা শুরুর আগেই ব্যাচভিত্তিক প্রাইভেট পড়া শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন জেনে যায়। রোববার (২৯ জুন) ছিল গণিত পরীক্ষা। এদিন পরীক্ষা শুরুর আগেই সকালে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন জেনে যায়। এমনকি প্রশ্নর কপি পরীক্ষা শুরুর আগেই অভিভাবকদের মাধ্যমে জাগো নিউজের হাতেও চলে আসে।
অভিভাবকদের অভিযোগ, চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নফাঁসে জড়িত স্কুলটির ইংরেজির শিক্ষক মো. আওলাদ হোসেন। আর নবম শ্রেণির গণিত বিষয়ের প্রশ্নফাঁসে জড়িত গণিতের শিক্ষক তপন কুমার বিশ্বাস। এছাড়া আরেক শিক্ষক মো. নুরুল হকের নামেও অভিযোগ উঠেছে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায়। যদিও নুরুল হক ব্যাচভিত্তিক শিক্ষার্থী পড়ান না।
স্কুলের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাচে যদি পড়তে দিই, তাহলে ছেলের রেজাল্ট ভালো হয়। কেন ভালো হয়? কারণ সারা বছর পড়ুক আর না পড়ুক প্রশ্নগুলো সব লিখে দেয় শিক্ষক। অন্যদের সন্তানকে পড়তে দেয় দেখেও আমিও দিয়েছি। কিন্তু এটা তো ওদের (শিক্ষার্থী) জন্য ভালো নয়। আমি সচেতন অভিভাবক হিসেবে ভেবে দেখলাম, এতে তো বাচ্চাদের ক্ষতি। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বললেও তারা পাত্তা দেন না।’
জানতে চাইলে অভিযোগ ওঠা তিনজন শিক্ষকই প্রশ্নফাঁসে নিজেদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন। গণিতের শিক্ষক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমি গণিত পড়াই, প্রশ্ন তৈরি করি এটা ঠিক। তবে প্রশ্নফাঁস বা কাউকে বলে দেওয়ার অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’
ইংরেজির শিক্ষক আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আমি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিই না বা নিতে আগ্রহী নই। আমি অষ্টম-নবমে ইংরেজি ক্লাস নিই। এবার আমাকে চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নটা করতে দেওয়া হয়েছিল, করেছি। কিন্তু আমি কাউকে প্রশ্ন বলে দিইনি। অন্য কারও হাত দিয়ে এটা ফাঁস হতে পারে।’ অভিযোগ ওঠা আরেক শিক্ষক নুরুল হককে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ‘দেখা করতে’ বলেন।
দায়িত্ব মাউশিতে, সারাদিন থাকেন স্কুলে!
২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর কলেজিয়েট স্কুলের মো. নুরুল হককে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) সংযুক্ত করা হয়। সেখানে শিক্ষকদের টাইম স্কেল নিয়ে কাজের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। তবে স্কুলের ‘মায়া’ ছাড়তে পারেননি নুরুল হক। প্রতিদিন তিনি স্কুলে এসে বসে থাকেন।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের দুজন শিক্ষক জাগো নিউজকে জানান, গত সেপ্টেম্বরে বদলি হয়ে মাউশিতে যাওয়ার পরও ডিসেম্বরে নুরুল হক অনৈতিকভাবে স্কুলের পরীক্ষা ফান্ডের টাকা গ্রহণের চেষ্টা করেন। তালিকায় তার নাম রাখা হয় এবং তিনি সইও করেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে তোপের মুখে পড়ে সেই অর্থ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। সামনেও পরীক্ষা ফান্ডের টাকা নেওয়ার জন্যই মূলত তিনি স্কুলে এসে বসেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, গণিতের শিক্ষক তপন কুমার বিশ্বাস ও নুরুল হক একই সিন্ডিকেটের। দুজনই জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। তপন কুমার ২০০১ সাল থেকে প্রায় ২৪ বছর ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে একটানা চাকরি করছেন। আর নুরুল হকও প্রায় ২২ বছর কলেজিয়েট স্কুলে রয়েছেন। সম্প্রতি গণিতের শিক্ষক তপনকে রসায়ন ক্লাস দেওয়া হয়েছে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী- তিনি রসায়ন ক্লাস পাওয়ার কথা নয়। নুরুল হক ও তপন কুমার মিলে এ রুটিন করাতে বাধ্য করেছেন বলেও অভিযোগ স্কুলের অন্য শিক্ষকদের।
এদিকে, সোমবার (৩০ জুন) সকালেও তিনি মাউশিতে অফিসে না গিয়ে কলেজিয়েট স্কুলে এসেছেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় জাগো নিউজের প্রতিনিধির। তিনি বলেন, ‘আমি স্কুলে (ঢাকা কলেজিয়েট) আছি। মাউশিতে যাইনি।’
মাউশিতে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নুরুল হক বলেন, ‘ডিডি (উপ-পরিচালক) আমাকে স্কুলে বসেই কাজ করতে বলেছেন। আমি স্কুলে বসে কাজ করি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. হাবিবুল্লাহ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়গুলো আপনি জানালেন। আমি এর আগে এমন অভিযোগ পাইনি। কেউ অভিযোগ করেননি। বিষয়টি জানলাম। আমরা এটা খতিয়ে দেখবো। সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে প্রশ্নফাঁস ও ব্যাচভিত্তিক প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার এমন ভালো একটি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কার্যক্রম তো মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়গুলোর খোঁজ-খবর নেওয়া হবে।’
সৌজন্যে : জাগোনিউজ