এরদোগানের ইউ-টার্ন ও সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্যমূলক নীতি

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩, ১১:৪২ |  আপডেট  : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩১

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের ন্যাটোতে ইউ-টার্নের পেছনে কারণ কি? অনেক বছর ধরে চলা অচলাবস্থার পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান সুইডেনের ন্যাটোর অর্ন্তভূক্তিকে সমর্থন করতে রাজি হয়েছেন। কেন এরদোগান তার নীতি পরিবর্তন করলেন? সুইডেনের ন্যাটো সদস্যতার জন্য রাজি হয়ে এরদোগান পশ্চিমকে ও বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেন। প্রশ্ন হলো, তুরস্ক কি পশ্চিমের দিকে ঝুঁকছে? তাহলে কি নির্বাচনের পরে, এরদোগান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সাথে আরও ইতিবাচক সম্পর্ক চাইছেন? আরেকটি কারণ হতে পারে যে, রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি, ফলে অর্থনৈতিক কারণে রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার তুরস্কর নীতি। এর ফলে আঙ্কারা ইইউ-তুরস্ক অর্থনৈতিক সুবিধা পেতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ন্যাটো সম্মেলনের প্রাক্কালে তুরস্কের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, কংগ্রেসের সাথে আলোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তুরস্কের কাছে এফ-১৬ জেট হস্তান্তরের বিষয়ে এগিয়ে যাবে। মার্কিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সুইডেনের উপর তুরস্কের ইউ-টার্নের আরেকটি কারণ।

এরদোগান আশা করেন যে একটি ইউ-টার্ন তুরস্কের পতনশীল অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারে। তুরস্ক আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হওয়ায়, এরদোগান তার বিতর্কিত অর্থনৈতিক নীতিগুলি পরিত্যাগ করেছেন। প্রাক্তন মার্কিন ব্যাংকার মেহমেত সিমসেককে অর্থমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগকে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার কমানোর অপ্রথাগত অর্থনৈতিক নীতির অবসান হিসাবে দেখা যায়। অনেকে এরদোগানের নিম্ন-সুদের হারের নীতিকে মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করেন। বর্তমানে বাজারে ফলমূল ও শাকসবজি ক্রয়ক্ষমতা মানুষের কমে গেছে। এরদোগানের পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পর তুর্কি লিরা রেকর্ড নিম্নে নেমে এসেছে এবং তুরস্কের কাছে অল্প বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশিষ্ট রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সুদের হার বৃদ্ধিকে আরও বেশি বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি এবং পশ্চিমা মিত্রদের কাছাকাছি যাওয়ার কৌশল হিসেবে গণ্য করা যায়। বর্তমানে তুরস্ক গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। দুই দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা এরদোগান সবচেয়ে বড় নির্বাচনী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, মে মাসে একটি রান-অফ ভোটে আরও পাঁচ বছরের মেয়াদে জয়লাভ করেন এবং তার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এবং তার মিত্ররা সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। .

বস্তুত ২০১৮ সালে তুরস্কের অর্থনৈতিক অবনতি শুরু হয়েছিল। মুদ্রা সংকটের কারণে ডলার-নির্ধারিত ঋণ পরিশোধের জন্য বিদেশী ঋণের উপর নির্ভরশীল হতে হয়েছিল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সংকট আরও তীব্র হয়, যখন সরকার নিউ ইকোনমি প্রোগ্রাম (এনইপি) বাস্তবায়ন করে। কারণ উচ্চ সুদের হার উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণ।  ডলারের বিনিময় হার নেমে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীট বৈদেশিক রিজার্ভ ২০০২ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশাল পতন হয়।  মে মাসের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ১২ মাসে, তুরস্কের সুদের হার ১৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল এবং ন্যূনতম মজুরি ২৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তুর্কিরা হঠাৎ করে বেশি উপার্জন করছিল এবং আরও কম সুদে ঋণ নিতে সক্ষম হয়েছিল। ফলস্বরূপ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার উচ্চতর ব্যয় মেটাতে লোকেদের অর্থ প্রদান করা মুদ্রাস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলেছিল। কিন্তু এরদোগানের যুক্তি ও নীতি অর্থনৈতিক ছিল না, ছিল নির্বাচনী জয়ের কৌশল এবং যা কাজ করেছিল, তিনি নির্বাচনে জয়ী হন।

তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে দীর্ঘদিন ধরে ন্যাটোতে অভ্যন্তরীণ বিঘ্নকারী হিসাবে দেখা হয়েছে। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য মস্কোকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছিল, তখন এরদোগান রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে "আমার বন্ধু" বলে উল্লেখ করেছিলেন। ন্যাটো নেতারা যখন জোটকে বড় করার জন্য কাজ করেছিলেন, এরদোগান তাতে বাঁধা দেন। একই সময়ে, তুরস্ক শুধুমাত্র রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অস্বীকার করেনি বরং বাণিজ্য সম্পর্ক প্রসারিত করেছে, রাশিয়ায় তুরস্কের রপ্তানি বাড়িয়েছে এবং রাশিয়ান গ্যাসের দাম কমিয়েছে। তবে বর্তমানে তুরস্কের রাশিয়া থেকে দূরে সরে যাওয়ার দুটি কারণ হলো: ইউক্রেনের আজভ রেজিমেন্টের যোদ্ধাদের গত সপ্তাহান্তে তুরস্ক থেকে ইউক্রেনে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত, যা বস্তুত ক্রেমলিনকে ক্ষুব্ধ করে এবং জুনে ওয়াগনার ভাড়াটে বাহিনী মোশার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় এরদোগান, পুতিনের পাশ ত্যাগ করা। তুরস্ক পশ্চিমের সাথে সম্পর্কের কারণে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া তীব্র ছিল। একজন রুশ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন যে তুরস্ক একের পর এক "উস্কানিমূলক" সিদ্ধান্তের পর একটি "বন্ধুত্বহীন দেশে" পরিণত হচ্ছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ন্যাটোতে যোগদানের জন্য সুইডেনের আহ্বানকে সমর্থন করার আসলে একটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিছুদি আগেও এরদোয়ান সুইডেনকে "বদমাশ এবং সন্ত্রাসীদের" আশ্রয় দেওয়ার জন্য তিরস্কার করেছেন। স্টকহোমের রাস্তায় কোরান পোড়ানোর অনুমতি দেওয়ার জন্য এরদোয়ান, সুইডেন সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এক পর্যায়ে এমনকি সুইডেনকে ন্যাটোর যোগদান নিয়ে তাকে অনুরোধ না করতে বলেছিলেন। তাছাড়া সুইডেনের কথিত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে দ্বন্দ্ব এবং তুরস্কের দাবি সুইডেন কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন। তখন সুইডেনে ডানপন্থীদের দ্বারা কুরআন পোড়ানো ফলে বিক্ষোভের কারণে উত্তেজনা আরও বেড়ে গিয়েছিল। তুরস্কের প্রতিবাদ ও নিন্দাকে সুইডিশ সরকার নিন্দা করেছিল, বলেছিল যে এটি সুইডেনের নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এরপর আশ্চর্যজনকভাবে সোমবার লিথুয়ানিয়ায় এক শীর্ষ সম্মেলনে এরদোগান ন্যাটো সামরিক জোটে সুইডেনের সদস্যপদকে সমর্থন করেন, সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসনের আলোচনার দক্ষতার প্রশংসা করেন এবং সুইডেনের সীমানা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এই পদক্ষেপ কি এরদোয়ানের বিদেশী নীতি পরিবর্তনের অংশ? না আঙ্কারার তাৎক্ষণিক স্বার্থে রাজনৈতিক লেনদেন হিসাব নিকাশ? তুরস্কের স্বর পরিবর্তনের কারণ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের (বিশেষ করে আমেরিকা ইউরোপের) ফিরিয়ে আনতে মরিয়া নীতি, যার ফলে তুরস্ক আশাকরে অর্থনৈতিক সংকট থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ২০২৩ সালের প্রথম পাঁচ মাসে তুরস্কের চলতি হিসাবের ঘাটতি ৩৭.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা একটি রেকর্ড। এরদোগানের সরকার আশা করছে যে বর্তমানে তার এসব পদক্ষেপের ফলে আমেরিকা ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা তুরস্কে অর্থায়নে সহায়তা করবে।

এরদোগানের মস্কোর প্রতি মনোভাবের আকস্মিক পরিবর্তন আসে মে মাসের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পরে, কারণ যেখানে এরদোগান সরকারের পশ্চিম-বিরোধী অবস্থানে জনগণের অসন্তোষ স্পষ্টভাবে স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছিল। পশ্চিমাদের সাথে টানাপোড়েন সম্পর্ককে অর্থনীতিকে বির্পযস্ত করার জন্য এবং বিদেশী বিনিয়োগকে সীমিত করার জন্য দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পতনের জন্যও এই নীতিকে জনগণ দায়ী করেছে। বর্তমানে পশ্চিমের প্রতি এরদোগানের ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করার ফলে, তুরস্ক আশা করে যে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এবং তুরস্কের অর্থনৈতিক ভাগ্য পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে। পশ্চিমাদের প্রতি এরদোগানের মনোভাবই বদলে যাচ্ছে। সুইডেনে ডানপন্থীদের দ্বারা কুরআন পোড়ানোর ফলে এরদোগান তার কঠোর অবস্থানকে ভুলে ন্যাটোতে যোগদানের জন্য সুইডেনের আহ্বানকে সমর্থন, এরদোগান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার অবস্থানকে ত্যাগ, পশ্চিমাদের প্রতি এরদোগানের মনোভাবই বদলে যাওয়ার উদাহরণ। আবার সুইডেনের ও রাশিয়ার প্রতি তার অবস্থার পরিবর্তনকে ব্যালেন্স করার জন্য এই সপ্তাহে তুর্কি নেতার সৌদি আরব সফর করেন। যেখানে জেদ্দায় ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে একটি বৈদ্যুতিক মূল্যবান গাড়ি উপহার এবং সে গাড়ি মোহাম্মদ বিন সালমান নিজে চালিয়ে হাসিমুখে ছবি তোলা, যা আঙ্কারা এবং রিয়াদের মধ্যে সম্পর্কের একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এরদোগানের সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্যমূলক নীতি, যেখানে মস্কোর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা এবং একই সাথে পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা, তার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                   লেখকঃ কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক, অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত