কথিত ধর্ম অবমাননা ও একজন শিক্ষক হৃদয় কৃষ্ণ মন্ডল!

  আবদুর রহমান

প্রকাশ: ৪ এপ্রিল ২০২২, ১১:৩৫ |  আপডেট  : ১৬ মে ২০২৪, ১২:৫১

মুন্সিগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের  সিনিয়র বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় কৃষ্ণ মণ্ডল ক্লাসে ধর্ম থেকে বিজ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন- ধর্ম আর বিজ্ঞান আলাদা বিষয়। কোন ধর্ম থেকেই বিজ্ঞান উৎপত্তি হয়নি৷ ধর্ম হলো বিশ্বাস আর বিজ্ঞান প্রমাণিত বিষয়৷ আর বর্তমান যুগের ৯০% বিজ্ঞানী ইহুদি, খ্রিস্টান। তারাতো কোরান পড়ে না।" এই বক্তব্যের কারনে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে তাঁর বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়া শুরু হল- ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, মালাউনের ফাঁসি চাই। শিক্ষকের দুই গালে জুতা মার তালে তালে৷' স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে কিছু স্বার্থান্বেষী কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগিয়ে ধর্মের নামে নিজেদের স্বার্থ স্বিদ্ধি করতে চায়। তাঁর নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি এখন জেলে। অবিলম্বে শিক্ষক হৃদয় কৃষ্ণ মন্ডলের মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। সেইসাথে যারা নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এই প্রগতিশীল শিক্ষককে হেনস্থা করেছে তাঁদের প্রতি নিন্দা জানাই।

কিছুদিন আগে ভাগ্যকুল হরেন্দ্রলাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের গভর্নিং বডির নির্বাচনী প্রচারনায়ও কিছু মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। সাধারন মানুষকে উত্তেজিত করতে চেয়েছে। ভাগ্যকুল পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কর্তৃক আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতাকে তাঁরা ধর্ম ও সরকার বিরোধী প্রকল্প হিসেবে মানুষের কাছে উত্থাপন করেছে। অথচ বিদ্যালয়ে ভাগ্যকুল পাঠাগার যে কয়টা পোগ্রাম করেছে তাঁর সবটাই লাইভ করে সবার বক্তব্যই প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে ধর্ম-সরকারবিরোধী কোন এজেন্ডাই ছিলনা। শিক্ষার্থীদের আমরা শেখাতে চেয়েছি ভিন্নমতকে কিভাবে সহ্য করতে হয়, বিতর্কের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান উৎপাদন হয়; মানুষ কথা বলতে শেখে। তর্কে হয় দ্বন্ধ, বিতর্কে বন্ধুত্ব। কথা বলার অধিকার না থাকলে সমাজে অন্য কোন অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয়না। বাকস্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। কারো কথার সাথে, লেখার সাথে আপনি দ্বিমত পোষন করতেই পারেন। কারো জীবনাচরন আপনার সাথে নাও মিলতে পারে তাঁই বলে তাঁকে আক্রমন করে, হত্যা করে, জেলে পুরে কারুর চিন্তাকে অবরুদ্ধ রাখা যায়না। চিন্তায় যে সমাজ স্থবির হয়ে যায় সে সমাজ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। কিন্তু প্রত্যেক সমাজেই একদল সুবিধাবাদী স্বার্থান্বেষী মূর্খ মৌলবাদীগোষ্ঠী থাকে যারা পছন্দ করেন না মানুষ কথা বলুক। তাঁদের বিশ্বাসের বিপরীতে মানুষ কোনকিছু করুক। এটাই উগ্রতা, ধর্মান্ধতা। রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত এমন ভাবাদর্শ প্রবলভাবেই বিদ্যমান। 

শাসকশ্রেনী নিজেদের অন্যায়, অযোগ্যতা, হঠকারিতা আড়াল করতেই ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারন মানুষের অনুভূতিশীল মনটাকে অনুভুতির চরমে নিয়ে যায়।

যখন দেশের মধ্যে গনতন্ত্রহীনতায়, বিচারহীনতায়, আর্থিক সমস্যায়,শ্রেনী- বৈষম্যে, পুঁজিবাদী শাসকদের দ্বারা দমন- পীড়নে জর্জরিত হয়ে জনগনের মনে গনবিক্ষোভের বীজ অংকুরিত হয়, তখন শাসক শ্রেনী দুটি তরুপের তাস ব্যবহার করে।

এক সাম্প্রদায়িকতার, দুই ধর্মান্ধতার।

লতা সমাদ্দার নামে একজন নারী শিক্ষিকাকে টিপ পড়ার কারনে একজন পুলিশ সদস্য হেনস্থা করেছে। এই যে ব্যক্তিপর্যায়ে সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নাই। কে কি পোশাক পড়বে? কেমন করে চলাফেরা করবে? কে কি বিশ্বাস করবে? তা কোন ব্যক্তি নির্ধারন করে দিতে পারেনা। এমনকি সমাজ ও রাষ্ট্রও না। সমাজ ও রাষ্ট্রের সেই এখতিয়ার নেই।

ধর্মান্ধতা সকল ধর্মেই রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ভগবানকে নিয়ে গল্প লেখার কারনে তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের হয়েছিল।পরে ক্ষমা চেয়ে পোষ্ট সরিয়ে নিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। 

নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানের করাচীতে একটি ঘটনা তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার বাজারের মধ্যে চিৎকার করে লোক জড়ো করে অভিযোগ করল যে; তার প্যাসেঞ্জারটি কুরআনের অবমাননা করে কথা বলেছে। এটা বলামাত্র কোনকিছু যোগজিজ্ঞাসা না করে; শতশত মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়লো হতভাগ্য প্যাসেঞ্জারের ওপর। গণপিটুনিতে লোকটি কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা গেলো। পরে তদন্তে জানা গেলো, প্যাসেঞ্জারটি আসলে মোটেই কুরআনের অবমাননা করে কথা বলেনি বরং সে ছিল একজন হাফেজে কুরআন ও সহজ সরল ধার্মিক মানুষ। অযৌক্তিক ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে ট্যাক্সি ড্রাইভার তাকে হেনস্থা করার জন্য এমন অভিযোগ করেছিল। বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে ফেসবুকে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা, এরপর হামলা- সহিংসতা। ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাই করারও প্রয়োজন কেউ অনুভব করেন না। তাই এসব বিষয়ে ধর্মীয়- সামাজিক প্রচারণা জরুরি।

আবদুর রহমান

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত