গর্জন বর্জন এবং অর্জন- মহিউদ্দিন খান মোহন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৩৮ |  আপডেট  : ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:৩৩

‘গর্জন’, ‘বর্জন এবং ‘অর্জন’ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তিনটি শব্দ। গঠন এবং উচ্চারণগত দিক দিয়ে দারুণ মিল রয়েছে এগুলোর মধ্যে। তবে ভিন্নতা রয়েছে অর্থগত ক্ষেত্রে। গর্জনের আভিধানিক অর্থ ‘উচ্চ গম্ভীর শব্দে’ বা ‘হুংকার’। গর্জনের আবার জোড়াশব্দ রয়েছে- তর্জন-গর্জন। এর অর্থ ‘শাসানো’ ‘রাগ প্রকাশ’ বা ‘ভয় দেখানো’। গর্জন আমরা শুনি জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে। নদী কিংবা সমুদ্রে শুনি ঢেউয়ের গর্জন, বনজঙ্গলে শোনা  যায় বাঘের গর্জন, আর অন্তরীক্ষে, অর্থাৎ আকাশ থেকে ভেসে আসে মেঘের গর্জন। এসব ছাড়াও আমাদের চারপাশে আরও গর্জন শ্রবণ করি আমরা। সেটা মানুষের গর্জন। অপরকে ভীতসন্ত্রস্ত করার অভিপ্রায়ে নিজেকে ভয়ংকর বলশালী হিসেবে জাহির করতে কেউ কেউ কণ্ঠকে উচ্চমার্গে তুলে তর্জন-গর্জন করে থাকে।

বর্জন মানে ‘পরিহার’ ‘ত্যাগ’ বা’ পরিত্যাগ’ করা। এ জগৎ সংসারে মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য যেমন কোনো না কোনো অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরতে হয়, তেমনি কিছু কিছু বিষয় বা জিনিসকে বর্জন করতে হয়। বিদ্যাশিক্ষার শুরুতেই যে বইটি পড়েছিলাম সেটার নাম ‘আদর্শলিপি’। সীতানাথ বসাক প্রণীত সে বইটি উপদেশবাণীর ভান্ডার। প্রথমেই ‘অ’ অক্ষরের পরিচিতির সঙ্গে ছিল উপদেশ-‘অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর’। অর্থাৎ অসৎ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বর্জন করতে বলা হয়েছে। পবিত্র ধর্মেও অসৎ মানুষের সঙ্গ, অসৎ কর্ম এবং অসৎ উপার্জন পরিহারের নির্দেশ আছে। সুতরাং অর্জনের ন্যায় বর্জনও মানবজীবনের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে সে বর্জন হতে হবে সুচিন্তিত। আবেগ কিংবা রাগ-ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু বর্জন করলে হিতেবিপরীত হতে পারে। হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে কল্যাণকর অনেক কিছু। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।

অর্জন শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই। এটি একটি অতি সহজবোধ্য শব্দ, সবাই বোঝেন। চেষ্টা বা পরিশ্রম দ্বারা যা পাওয়া যায় সেটাই অর্জন। মানুষ তার চেষ্টার দ্বারা সাফল্য অর্জন করে। তবে সে চেষ্টা যদি ভুলপথে হয়, তাহলে তা পরিশ্রমকে পরিণত করে প-শ্রমে। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকান্ডের মধ্যে আমরা গর্জন, বর্জন এবং অর্জনের সমাহার দেখতে পাই। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে তারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে। এ আন্দোলন চালাতে গিয়ে দলটির ‘শিখর থেকে শেকড়’ পর্যন্ত নেতারা তর্জন-গর্জন করেছেন বেশুমার। দিয়েছেন ব্যাঘ্র-হুংকার। তাদের সে গর্জনে অনেক সময় মনে হতো, লীগ সরকারের বিদায় বুঝি সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু অবশেষে দেখা গেল, তাদের ওইসব তর্জন-গর্জন সবই পরিণত হয়েছে বায়বীয় আস্ফালনে। মঞ্চ-মাইকে তারা নিজেদের যতটা বলশালী বলে জাহির করেছেন, আন্দোলনের মাঠে তার ১ শতাংশ দেখাতে পারেননি। তারা যখন আন্দোলনকে ‘গণ আন্দোলনে’ পরিণত করে গণ অভ্যুত্থানে পরিণত করার বাগাড়ম্বর করছিলেন, সচেতন ব্যক্তিরা স-সংশয় প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিএনপির সে সক্ষমতা নিয়ে। আওয়ামী লীগের মতো দৃঢ় সাংগঠনিক শক্তি ও নেটওয়ার্ক সমৃদ্ধ রাজনৈতিক দলের সরকারকে আন্দোলনে মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বিদায় করা যে বিএনপির মতো অগোছালো সাংগঠনিক কাঠামোর দলের পক্ষে অসম্ভব এটা সাধারণ মানুষ বুঝলেও বিএনপি নেতৃত্ব বোঝেননি। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, জনসাধারণের একটি বড় অংশের সমর্থন বিএনপির প্রতি রয়েছে। তাছাড়া বিগত বছরগুলোতে দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, সরকারি দলের কর্মী-ক্যাডারদের উৎপাত, ব্যাংক খাতে চরম অব্যবস্থা এবং সার্বিক অর্থনৈতিক সংকট আর জনসাধারণের একটি অংশকে সরকার তথা আওয়ামী লীগের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। জনগণের এ অংশটির মধ্য বিএনপি করেন না বা আওয়ামী লীগের সমর্থক, এমন মানুষও আছেন। বিএনপি যদি ভোটে আসত তাহলে তারা হয়তো বা ধানের শীষেই সিল মারত। কিন্তু বিএনপি তাদের সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। ফলে আওয়ামী লীগ সহজেই একটি কঠিন নির্বাচনি সমুদ্র সহজেই পাড়ি দিতে পেরেছে। মূলত ২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে বিএনপি নিজেদের শক্তির, ওপর আস্থাশীল হয়ে উঠে। বিশেষত এই সময়ে দেশের বড় বড় শহর-নগরে জনসমাবেশে নেতা-কর্মীদের বিপুল উপস্থিতি তাদের অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। সে কারণে সমঝোতা-সংলাপের প্রস্তাবকে একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছে দলটি। স্মরণযোগ্য, সে সময় আন্তর্জাতিক কতিপয় সংস্থা ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রের বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ সরকারকে সংযত আচরণে বাধ্য করেছিল। ফলে বিএনপিসহ অন্যান্য দল নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পারছিল। সরকারের এই ‘আপাত নমনীয় আচরণ’ বিএনপিকে সাহসী করে তুলেছিল। নেতা-কর্মীরা দলে দলে আসতে শুরু করেছিলেন দলের সভাসমাবেশে। রাজপথে নেতা-কর্মীদের এ উপস্থিতিকে বিএনপি নেতৃত্ব তাদের প্রতি ‘জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন’ বিবেচনা করে আশাবাদী হয়ে ওঠেন আন্দোলনের সফলতা সম্পর্কে। মঞ্চে নেতাদের কণ্ঠস্বর উঠে যায় অতি উচ্চমার্গে। মাইক ফাটিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়ে তারা সরকারকে টেনে নামানোর হুংকার দিচ্ছিলেন। সরকারের নমনীয়তার সুযোগে বিএনপি নেতাদের ওইসব হম্বিতম্বি দেখে সে সময় ‘বিএনপির অক্টোবর বিপিএল সম্ভব হবে কি’ শীর্ষক এক নিবন্ধে আমি মন্তব্য করেছিলাম, ‘রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের প্রশ্ন-একটি আন্দোলন গণ আন্দোলন বা গণ অভ্যুত্থানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে যে ধরনের জনসম্পৃক্ততা দরকার, বিএনপি এখনো তা ঘটাতে পেরেছে কি না। এটা ঠিক, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে গত ডিসেম্বর (২০২২) থেকে তাদের কর্মসূচিগুলোতে জনসমাগম বেশি হচ্ছে। কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষের সংখ্যা কত? পর্যবেক্ষক মহলের মতে, সরকারের আপাত সহনশীল আচরণের কারণে একরকম ভীতিহীন পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় নেতা-কর্মীরা বেশি সংখ্যায় দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। সরকার কঠোর হলে রাজপথে তাদের উপস্থিতি কতটা থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৬ অক্টোবর ২০২৩)।
উল্লিখিত নিবন্ধটি প্রকাশের মাত্র ২২ দিন পরেই আমার সে মন্তব্যের বাস্তব রূপ দেখে নিজেই বিস্মিত হয়েছি। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের মহাসমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম হয়েছিল। সরকার সে সমাবেশ করতে কোনো বাধা দেয়নি, এমনকি সরকারি দলও কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করেনি। শান্তিপূর্ণভাবেই সমাবেশটি শুরু হতে যাচ্ছিল। কিন্তু একটিমাত্র ঘটনা পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। কাকরাইলে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে বিএনপি কর্মীদের ছোট একটি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে ঘটে যায় তুলকালাম কান্ড। বিএনপির মহাসমাবেশস্থল পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। পুলিশের নির্বিচার লাঠিচার্জ, গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপে মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে যায় নয়াপল্টন। রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের মতে, বিএনপি নেতারা যদি সেদিন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতেন এবং পুলিশ যদি সহনশীল আচরণ করত, তাহলে ঘটনাটি এতদূর গড়াত না। সেদিন দলের মারমুখো কর্মীদের নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। অন্যদিকে বিএনপির মহাসমাবেশকে প- করার সুযোগটি হাতছাড়া করেনি পুলিশ, তথা সরকার। বিএনপি নেত্বত্বের উচিত ছিল কর্মীদের নিরস্ত করে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সম্পন্ন করার জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়া। কিন্তু তারা সেটা না করে শুরুর আগেই সমাবেশ সমাপ্ত করে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করে বসেন। বলা নি®প্রয়োজন, সে হরতাল কর্মসূচি সফল করার জন্য দলটির নেতা-কর্মীরা কেউ মাঠে নামেননি। তারপর শুরু হয় তাদের থেমে থেমে হরতাল-অবরোধ ঘোষণা। তবে ওই কর্মসূচি সফল হয়নি। প্রথম কয়েকদিন রাস্তাঘাটে যানবাহন কম চললেও পরে তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। হরতাল-অবরোধের প্রতি মানুষ সাড়া না দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও বিএনপি নেতৃত্বের বোধোদয় হয়নি। তারা ডাক দেয় অসহযোগ আন্দোলনের। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। বিএনপি তফসিল প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার একটি অংশ তারা কার্যকর করতে সক্ষম হয়। সেটি হলো নির্বাচন বর্জন। নির্বাচন প্রতিহত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, হওয়ার ন্যূনতম কারণও ছিল না। ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা কারাবন্দি হওয়ার পর বাকিরা চলে যান অজ্ঞাতবাসে। আর নেতাদের এমন অদৃশ্য হওয়ার ঘটনায় কর্মীরা হতাশ হয়ে যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। আন্দোলন বেওয়ারিশ লাশের মতো রাস্তায় পড়ে থাকে।

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। তারা জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিল ভোট বর্জন ও তা প্রতিহত করতে। সে আহ্বান থেকে কোনো সুফল তারা পায়নি। বাংলাদেশের রাজনীতির দুই দিকপাল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। কোনো নির্বাচনের এর একটি যদি অংশ না নেয়, তাহলে সে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অর্থবহ হয় না। এবার বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ সমস্যাকে আওয়ামী লীগ এক অভিনব পন্থায় মোকাবিলা করে। দলীয় মনোনয়নের বাইরে নেতা-কর্মীদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত করে দেয়। ফলে কৃত্রিম হলেও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়ে ওঠে। এতে সরকার এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করে। এক. বিএনপির অনুপস্থিতিতে নির্বাচনি পরিবেশ উৎসবমুখর করতে সক্ষম হয়। দুই. দলের মধ্য থেকে কিছু  নেতাকে নির্বাচিত হয়ে আসার পথ উন্মুক্ত করে; যার প্রতিফলন ঘটেছে দেশের সংসদীয় ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে। নির্বাচন অনুষ্ঠান সফল হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারও গঠন করে ফেলেছে।

এখন প্রশ্ন উঠছে, আন্দোলনের গর্জন এবং নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে বিএনপি কী অর্জন করল? যদিও এখনো বিএনপি নেতারা নির্বাচন বাতিল ও নতুন নির্বাচনের দাবি করছেন। তবে তাদের এ দাবিকে অনেকেই অরণ্যে রোদন মনে করেন। আন্দোলন থেকে বিএনপির অর্জন সম্পর্কে জানতে গিয়েছিলাম দলটির কয়েকজন কর্মী-সমর্থকের কাছে। তারা বললেন, আন্দোলনের গর্জন আর নির্বাচন বর্জন থেকে বিএনপির অর্জন কয়েকশ নতুন মামলায় ১৫ হাজার কর্মীর জেলবাস, পুলিশি হয়রানি এবং আরও পাঁচ বছর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো।  কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাঁচ বছর পরও কি দলটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে? এ বিষয়ে বারান্তরে আলোচনার ইচ্ছা রইল। 

সৌজন্যে- বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

সান

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত