শহীদ আসাদ কেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক

  নূরুদ্দীন দরজী

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ১৭:০৭ |  আপডেট  : ১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৬

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, সংগ্রামে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান একটি মাইলফলক। বাংলার ছাত্র সমাজ ওই গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিলো। শোষণকারী স্বৈরাচার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর  ৬ দফা এবং ছাত্র সমাজের ১১ দফার ভিত্তিতে সমগ্ৰ দেশ জুড়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম চলছিলো। তার প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাপি গণ তুমুল অভ্যল্থানের সৃষ্টি করে। সংক্ষেপে বলতে গেলে  ১৯৬৯ এর  ২০ জানুয়ারি ছিলো গণ আন্দোলনের সূতিকাগার। সেদিন সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়েছিলো। ঢাকার বটতলা থেকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষনা দিয়েছিলো'যতদিন পর্যন্ত ষড়যন্ত্র মূলক আগরতলা মামলা প্রত্যাহার না করা হবে ততদিন‌ই আন্দোলন চলবে।, রাজবন্দীদের মুক্তি চেয়ে শ্লাোগানের পর শ্লোগানে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিলো। স্বৈরাচারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন তোফায়েল আহমদ,খালেদ মোহাম্মদ আলী এবং আসাদুজ্জামান আসাদ। গদি রক্ষা হবে না বুঝতে পেরে স্বৈরাচারের এক পুলিশ ইন্সপেক্টর তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে। ওই গুলি এসে লাগে আসাদের বুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসাদের মৃত্যু হয়, তিনি শহীদ হন। তাঁর গায়ের শার্ট রক্তে লালে লাল হয়ে যায়। সাথে সাথে আসাদের শার্টকে ছাত্র জনতা আরো বৃহৎ সংগ্রামের পতাকা বানায়। আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ নেয়, দাবী আদায় না হ‌ওয়া পর্যন্ত তাঁরা মায়ের কোলে ফিরে যাবে না।
        
সারা দেশে আসাদ শহীদ হ‌ওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরের দিন ২১ জানুয়ারি গায়েবানা জানাজা পড়াসহ হরতাল পালিত হয়। আর সেদিন‌ই বাঙালি সত্তা ও অস্তিত্ব আসাদের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ওই দিন‌ পল্টনের সভা থেকে পরবর্তী তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষনা করা হয়। ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল ও শোক মিছিল এবং ২৪ জানুয়ারি অর্ধ বেলা হরতাল। প্রতিদিনের কর্মসূচিতে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ  স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। অফিস আদালত , শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকান পাট ও  প্রতিটি বাড়িতে কালো পতাকা উড়ে। ঢাকা শহর পরিনত হয় মশালের নগরীতে। দেশ ছেয়ে গিয়েছিলো হরতাল আর হরতালে। সমগ্ৰ জনপথ গণ জাগরণ ও গণ অভ্যল্থানে  পরিনত হয় । কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র জনতার একটিই মাত্র প্রশ্ন ছিলো - কবে শেখ মুজিব আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাবেন? গণ বিস্ফোরণে ও জনরোষে প্রকম্পিত ছিলো সারা দেশ।

২০ জানুয়ারিতে আসাদের রক্ত দানের মাধ্যমে যে জনরোষ ওগণ বিস্ফোরণ তৈরি হয়েছিলো তার‌ই  ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মতিউর ও পরে মকবুল,আনোয়ার রুস্তম আলমগীরসহ অনেকে। এর প্রেক্ষিতে লাখ লাখ জনতা সবকিছু ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলন দাবানলের মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে ও গতি পায় । বিক্ষুদ্ধ জনতা আগুন ধরিয়ে দেয় সরকার সমর্থিত পত্রিকা অফিস ও ভবনে।  কয়েকটি পত্রিকা অফিস ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি এস রহমান তার বাসা থেকে এক কাপড়ে পালিয়ে যায়। খাজা শাহাবুদ্দিন সহ কয়েকজন মন্ত্রীর বাসায় আগুন ধরে যায়। শহীদ মতিউরের লাশ নিয়ে পল্টনে লাখ লাখ মানুষ জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষুদ্ধ জনতা প্রস্তুতি নেয় গভর্নর হাউস আক্রমণ করার। বিক্ষুদ্ধ মানুষ উত্তাল হয়ে উঠলে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার রেডিতে কারফিউ জারি করে। কিন্তু আপামর জনগণ বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, তাদের প্রিয় নেতা  বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলন চালিয়ে যায়। ঢাকা পরিনত হয় শুধুই মিছিল ও কাল ব্যাজ ধারী মানুষের শহরে। এভাবে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তরে আন্দোলন বিস্ফোরণ মুখী হয়। বাঙালি জনতার নিকট স্বৈরাচার একটু একটু বেকায়দায় পড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে ২২ ফেব্রুয়ারিতে বাঙালির অবিসংবাদিত প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু বের হয়ে এলে  আন্দোলন আরো চাঙ্গা হয়ে উঠ এবং তাঁর‌ই নির্দেশিত পথে সকল কিছু এগিয়ে যেতে থাকে।  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ মানুষের  জীবন দানের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়। আজ আমরা স্বাধীন জাতি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এখানে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে,১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের বীরোচিত জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে  যে আন্দোলন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো এবং বাংলার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়েছিলো  সে আন্দোলনের‌ই সোনালী ফসল হয়ে ফুটে উঠেছিলো বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবংশীর মুক্তি, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রাপ্তি, ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ। সর্বশেষে বঙ্গবন্ধুর আহবানে  ৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ করে এক সাগর রক্ত ঢেলে এসেছে আমাদের বহুল আকাঙ্খিত বিজয়। 

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের রক্ত দানের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে যেভাবে বাঙালিরা ফুঁসে উঠেছিলো, স্বাধিকার আন্দোলন যেভাবে দানা বেঁধে উঠেছিলো তার ধারাবাহিকতায় আজকে আমাদের স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। আসাদের নাম বাংলার ইতিহাসে এবং বাঙালি হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে ।  বাঙালি জাতির নিকট শহীদ আসাদ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক।

লেখকঃ লেখক,কলামিস্ট ও সাবেক শিক্ষা অফিসার।

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত