বৃহব্বলতা - বর্ণালী চ্যাটার্জী 

  বর্ণালী চ্যাটার্জী 

প্রকাশ: ৮ মে ২০২৫, ১২:০৭ |  আপডেট  : ৮ মে ২০২৫, ১৬:২২

ঠাৎ দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠলো সেই সঙ্গে অনির মোবাইলটা ও। আমি অনির জন্য ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত, গোরা কে বাজারে পাঠিয়ে ছিলাম কিছু সব্জী আনতে আর অনি ওয়াশরুমে। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। বেল আবারও বেজে উঠলো, আমি কিছু উপায়ন্তর না দেখে চটজলদি গায়ে একটা গামছা দিয়ে খুলতে এলাম। এসে দেখি বাইরে এক অপরিচিত ভদ্রলোক একটা লাগেজ ব্যাগ নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই বলে উঠলো আপনি সুমনা তো অনির ওয়াইফ... অনি আমার বাল্য বন্ধু, আজকের ফ্লাইটেই দিল্লী থেকে সোজা কলকাতায় এলাম। অনি কোথায় ও তো এখন মস্ত বড়ো কবি -সাহিত্যিক হয়েছে... আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও দুবার পাওয়া হয়ে গেলো ----তা মহাশয় কি বাড়িতে আছেন নাকি বেরিয়ে গেছেন? সুমনা খানিক্ষন অপলক দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর বলল আপনি ভিতরে আসুন। এই মুহূর্তে অনিও ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। জয়কে দেখে খানিকটা হতবাক হয়ে গেলো, বললো কিরে বলা নেই কয়া নেই চলে এলি যে। জয় হাসতে হাসতে বললো সারপ্রাইস ফোন করে ছিলাম তো ধরলি না তো। যাক ভালোই হলো অনেক বছর বাদে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে বেশ ভালোই লাগছে। তুই থাকবি তো... আফকোর্স ধরেনে আপাতত seven days তারপর প্রয়োজন পড়লে পরে দেখা যাবে। অনি বললো আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে, একজন ক্লাইন্ড আসবে উত্তর করিয়া থেকে ওকে মিট করতে হবে। এখন সুমনার সাথে তোর আলাপ পর্বটা সেরে রাখ... জয় একটু মুচকি হেসে বললো সে তো করবোই কিন্তু তুই থাকলে বেশি ভালো হত।

সুমনা জয় কে বললো আপনি একটু বসুন আমি একটু চেঞ্জ করে আসছি। সুমনা চেঞ্জ করে দু'কাপ কফি নিয়ে ড্রয়িং রুমে এল... জয় কে বললো নিন ধরুন কফি খান। কফি খেতে খেতে দুজনে মধ্যে অনেক কিছু নিয়ে কথা হোল। অনি সম্পর্কে সুমনা জয় কে অনেক কিছুই জানালো... বললো আপনার বন্ধুর এত পাঠক প্ৰিয়তা বেড়েছে যে আমার দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশটুকু তাঁর নেই। অনেক রাত করে বাড়িতে ফেরে, যার জন্য আমাদের এক মাত্র ছেলে কে হোস্টেলে রাখতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছি। আমার সাথে কথা বলা তো দূরের,অসুখ -বিশুক হলে সেটা বাড়ির কাজের লোক গোরার দায়িত্বে ছেড়ে দেয়। সময় অসময় আমাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে। ক্রমেই জীবন নরক হয়ে উঠেছে। মা বাবার সম্মতিতেই আমি ওকে বিয়ে করে ছিলাম, কত বিশ্বাস ভরসা ছিলো ওর প্রতি কিন্তু সে এখন অন্যদের নিয়েই ব্যাস্ত।

আমি অনেকটাই ইমোশনাল হয়ে পড়েছি, শুধু আমার কথাই বলে চললাম। এবার আপনি আপনার কথা বলুন ---জয় বললো আমার বলার মত তেমন কিছু নেই... আজ প্রায় পাঁচ বছর হলো আমি নীলাঞ্জনা কে হারিয়েছি,আমার ওয়াইফ। তুমি নিশ্চই শুনেছো অনিরকাছে।হ্যাঁ তবে তেমন ভাবে কিছু শুনিনি। আপনার বন্ধু তো বাইরের জগৎ নিয়েই ব্যস্ত থাকে, আমাকে বলার মত সময় তাঁর কোথায়! এই যা আপনাকে 'তুমি' বলে ফেললাম... প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।আরে না,আপনি তুমিই বলুন না।আমার শুনতে ভালো লাগছে।

নীলাঞ্জনা মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলো। যার কোনো ওষুধ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি অর্থাৎ ক্যান্সার। তবে একটা ভালো দিক ছিলো সেটা হলো আমাদের কোনো সন্তান ছিলো না, তাহলে আমি আগাদ জলে পরতাম। সুমনা জয় কে জিজ্ঞাসা করলো আপনার আর দ্বিতীয় বার সংসার করতে ইচ্ছে হয়নি? জয় হোহো করে হেসে বললো- একেবারে যে হয়নি- তা নয়, আবার দ্বিতীয় বিয়ে করার রিস্কটা ও নিতে ভয় হয়। সুমনা বললো কেন... আপনিতো বেশ হ্যান্ডসাম, স্মার্ট এবং উচ্চ পদস্ত পেশায় নিযুক্ত, বারে ভয় হবে কেন? জয় বললো উত্তর দেবো তোমাকে আগে আমাকে আপনি বলাটা ছাড়তে হবে। সুমনা বললো বেশ তো না হয় আপনাকে তুমিই বললাম ----এবার খুশি তো। তোমার মত কাউকে পাইনি বলে আর রিস্ক নিতে সাহস করলাম না। সুমনা বলে উঠলো তুমি কি আবোল তাবোল যে বলো তার মাথা মুন্ডু আমি খুঁজে পাইনা।জয় হাসতে হাসতে সুমনার হাত দুটো চেপে ধরলো, জয়ের স্পর্শে সুমনার শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমেই ভারি হতে থাকলো। সুমনার কাছে ঐ মুহূর্তটুকু যেন মনে হয়ে ছিলো তার জীবনে আবার প্রেমের নবজাগরণ ঘটেছে। পরক্ষনেই সুমনা হাত দুটো সরিয়ে নিলো এবং লাজ্জিত হলো। সুমনার শারীরিক গঠন খুবই আকর্ষণীয়।তাছাড়া সে শিক্ষিতা ও রুচিশীলা, সাহিত্য কখনো ও তাকে টানেনি এই জিনিস গুলো জয়ের তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বাড়িয়ে তুলে ছিলো।

রাত যখন বারোটা তখন অনি বাড়ি ফিরলো... সুমনা জয়ের সাথে আজ আর আড্ডা দিতে পারলাম না, আমি বাইরে থেকে ডিনার করে এসেছি শরীর খুব ক্লান্ত, ফ্রেশ হয়ে ঘুমোবো তুমিও শুয়ে পডো। সুমনা খানিক্ষন বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো তার রাগান্বিত চোখ দিয়ে ঝড় ঝড় করে জল পড়তে লাগলো। নিজেকে একটা আস্ত জড়ো পদার্থের মত মনে হতে লাগলো। সেই মুহূর্তে সে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের উপর তার এই একাকিত্বের জ্বালা উন্মোচন করতে গেলো। আকাশের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো হা ঈশ্বর আমি কি পাপ করে ছিলাম তুমি আমায় সব কিছু দিয়েও আমার ভালোবাসা শারীরিক, মানুষিক সন্তুষ্টি সব কিছু কেড়ে নিলে... কেন? কেন? চল্লিশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমি আজ এগুলো থেকে বঞ্চিত। হয়তো বহু পুরুষ আমায় দেখে বিগলিত হয়ে যায়,আমি ইচ্ছে করলেই তাঁদের সান্নিধ্য পেতে পারি কিন্তু বিবেকের কাছে পরাজিত হই সম্মানে। শিক্ষায় ও রুচিতে বাঁধে। মুখে সব সময় নকল হাসি নিয়ে সবার সামনে অভিনয় করতে হয়। এটাই কি আমার ভবিতব্য!

হঠাৎ চারিদিকে নিস্তব্ধতার মাঝে কারো যেন পায়ের শব্দ সুমনার কানে ভেসে এল, পিছু ফিরতেই সে দেখলো জয় দাঁড়িয়ে আছে। সুমনা চোখ মুছতে মুছতে বললো কখন এলে কিচ্ছুটি টের পেলাম না...জয় বললো আমি টের পায়েছি তোমার নিঃশব্দ কান্নার...সুমনা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। বললো এমন কিছু নয়, এরকমটা আমার মাঝে মধ্যেই হয়। আমার কথা থাক তুমি ঘুমোয়নি কেন? নতুন জায়গা, খাট বিছানা নতুন তাই ঘুম আসছে না, মানিয়ে নিতে আরও দুদিন লাগবে। পূর্ণিমার আলোতে চারিদিকে একটা তুলো পেজা শুভ্র সিগ্ধতার আবেশ, এ মুহূর্তে জয় বলে উঠলো আজ থেকে তোমার নাম রাকা। সুমনা বললো কেন? জয় উত্তর দিলো কেন আবার পূর্ণিমার শুভ্র চাঁদ তোমার মধ্যে বিরাজ করছে তাই তুমি রাকা... হা হা করে সুমনা হেসে উঠলো। সুমনাকে হাসতে দেখে জয় তাকে জড়িয়ে ধরে সিগ্ধ হাসির ছোঁয়া মাখা ঠোঁট দুটোর মধ্যে নিজের ঠোঁট দুটো দিয়ে চুম্বন করতে লাগলো, নিমেষে সুমনা সমস্ত অবহেলা, অবজ্ঞা ভুলে গিয়ে জয়ের সামান্য স্পর্শে অসামান্যতা খুঁজে পেলো। খুঁজে পেলো তার নারীত্ব, নব যৌবন এবং নতুন করে কাউকে ভালোবাসার স্পর্ধা। সুমনার প্রত্যেকটা রোমকূপ খাড়া হয়ে গেলো তার মনে হলো... জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে কেউ যেন এক বালতি জল ঢেলে দিলো। সুমনা তার উন্মুক্ত বক্ষে জয় কে জড়িয়ে ধরে বললো ----আমায় তুমি এই ভালোবাসাহীন, নির্জন, নিস্প্রান বাড়িটা থেকে মুক্তি দিতে পারো, পারবে ঐ ভালোবাসাহীন, লম্পট মানুষটার কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে যেখানে ও আর আমার নাগাল পাবে না...

সুমনা বললো আমি খুব ভালো নাচ করতাম, ইচ্ছে ছিলো বড়ো নৃত্য শিল্পী হবার ,তবে অনি সেটা চায়নি। তাই আমি নিজের শিল্প সত্তা কে অনির ইচ্ছায় বিসর্জন দিয়েছি কিন্তু অনি তাঁর ব্যাক্তিগত ক্যারিয়ার বিল্ডআফের জন্য আমাকে পরোক্ষ ভাবে অবহেলাই করেছে। দৈহিক সুখ সে তার মহিলা কবি বন্ধুদের কাছে নিয়েছে, সেটা জেনেও আমি কখনো তাঁর উপর অভিমান করিনি। আমি এই বাড়িতে কেবলি একটি জীবন্ত লাশ। তাই আজ জয় তোমার কাছে মুক্তি পাবার আশা ভিক্ষা করছি।

এই কথা শোনার পর জয় সুমনাকে দৃঢ়তার সঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরলো। সুমনার শরীরের প্রত্যেটি ভাজে ভালোবাসার চিহ্ন বপন করে দিলো। জয় মনে মনে ভাবলো জানিনা এই চিহ্ন গুলোর স্থায়িত্ব কত দিনের, তবে এটুকু আশা রাখি সুমনা আমায় তার স্মৃতিতে চিরকাল তুলে রাখবে... ভুলতে পারবে না।

জয় কোথায় যেন আনমনা হয়ে ভাবলো -আজকের এই দিনটি সে কি পৃথিবীতে কারো কাছে বলে অনুভূতি শেয়ার করে পারবে? কারণ যার কাছে পারার কথা- সেই মনীষা কে তো সবে তিনদিন আগে অ্যাবোরশন্ করিয়ে আগামী দিনে তার বাকি জীবনের সঙ্গী হওয়ার আশ্বাস দিয়ে সে এসেছে...

সুমনা ও মনীষা  যেন এক ধ্রপদী করুন রাগের বাদী বা সমবাদী স্বর।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত