ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ

  ইরফান শেখ 

প্রকাশ: ৮ মে ২০২৫, ১৬:১৪ |  আপডেট  : ৮ মে ২০২৫, ১৯:৫৬

চেয়ারে বসা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। দাঁড়িয়ে আছেন, মথুরেন্দ্রনাথ নন্দী, মুহম্মদ আবদুল হাই। নিচে বসা আই এন চৌধুরী, আহমদ হোসেন, বিশ্বরঞ্জন ভাদুড়ী, কলকাতা, ১৯৩৮ সাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স আজ ১০০ বছর। আর রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ঠিক ১৬০ বছর। ঢাবির চেয়ে ৬০ বছরের বড় এই রবি ঠাকুর নাকি কোনওদিন চাননি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক। এখনও ঢাবির আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয় যে রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেছিলেন, 'পূর্ববাংলার চাষা ভুষারা আবার পড়াশোনা কী করবে? তারা হালচাষ করুক।' যদিও এ নিয়ে কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।

তবে এ নিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় যে রবি ঠাকুর নওগাঁ আর কুষ্টিয়াতে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের পড়াশোনার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন, স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিজের ছেলেকে অন্য কিছু না পড়িয়ে আমেরিকাতে কৃষি পড়িয়ে কুষ্টিয়ার লোকজনের উন্নতি করাতে চেয়েছেন। সমবায় কৃষি আর পূর্ববঙ্গের শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন। 

যে মানুষটা নিজের বউ এর গহনা বিক্রি করে পূর্ব বাংলায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি আর যাই করুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করবেন না। কেউ কোনো প্রমাণ না দিয়েই বলে বেড়াচ্ছেন যে, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে এক বিরাট জনসভা হয়। সেই জনসভায় সভাপতি হিসেবে রবি ঠাকুর নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন।

এটা সত্য যে কলকাতায় ২৮ মার্চ এ রকম একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিতই ছিলেন না। সেদিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না। ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ 'সিটি অব প্যারিস' জাহাজে করে রবীন্দ্রনাথের লন্ডন যাবার কথা ছিল। তাঁর সফরসঙ্গী ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ জাহাজে উঠে পড়েছিলেন। কবির মালপত্রও তোলা হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু হঠাৎ সেদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে যান। পরে চেন্নাই থেকে তাঁর মালপত্র আবার কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। কলকাতায় কয়েক দিন বিশ্রাম করে ২৪ তারিখ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে চলে আসেন। ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে সেখানে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেন, যেগুলো পরে 'গীতিমাল্য' (১৯১৪) গ্রন্থে সংকলিত হয়। 

গীতিমাল্য-এর ৪ নম্বর কবিতা হচ্ছে ‘স্থিরনয়নে তাকিয়ে আছি’। এই কবিতার পান্ডুলিপিসহ সকল সংস্করণেই রচনাকাল আর রচনাস্থান দেওয়া আছে। শিলাইদহে ১৫ চৈত্র ১৩১৮ সাল তারিখে (২৮ মার্চ ১৯১২) এই কবিতা লেখা হয়। (দলিল: https://www.tagoreweb.in/.../sthir-noyone-takiye-achhi-3369)

২৮ মার্চ তিনি এই কবিতা কুষ্টিয়ায় বসে লিখলে কলকাতায় বক্তৃতা করবেন কীভাবে! তাছাড়া ডেইলি স্টেটসম্যান পত্রিকা তখন কলকাতার দৈনিক প্রথম আলো। ১৯১২ সালের ২৯ মার্চ তারিখের স্টেটসম্যানে এই সভার কথা ছাপা হয়েছিল। স্টেটসম্যানের সাংবাদিকেরা গড়ের মাঠের এই জনসভার নিউজ করবেন আর সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম লিখতে ভুলে যাবেন তা হতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছেন এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে রবীন্দ্রনাথের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমের সম্পর্কের নানান প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা সফরে আসেন। আহসান মঞ্জিলে এসে উঠেন। মানে তখন উনি ঢাকার নবাবের মেহমান। সেবার উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা গ্রহণ করেন। নবাব সলিমুল্লাহ সেই ১৯০৪ সাল থেকে সংগ্রাম করছেন ঢাবির প্রতিষ্ঠার জন্য। সেই সংগ্রামের বিরোধিতা যদি রবি ঠাকুর করেন, তবে মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে ঢাবি তাকে সংবর্ধনা দিতো না। আর ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ নিজের বাবার সংগ্রাম ভুলে গিয়ে রবি বাবুকে সম্মান করে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতেন না। আজ ১০০ বছর পরে যে বিষয় আমরা ভুলতে পারি না, মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে নবাব হাবিবুল্লাহ আর সমগ্র ঢাবি সেকথা ভুলে যাবে - এটা মানা কষ্টকর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসেন মোট দুইবার। ১৮৯৮ সালে প্রথমবার, আর দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালে। দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসার পর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন ঢাকার নবাব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ আমন্ত্রণে। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথকে আনতে মূল ভূমিকা পালন করেন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার।

তবে রবীন্দ্রনাথ কার বাসায় উঠবেন — এ নিয়ে ঢাকার জনগণ ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ঘটনা রবীন্দ্রনাথের কানেও গড়ায়। রবীন্দ্রনাথ খানিকটা বিব্রত হয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদারকে চিঠি লেখেন -

কল্যাণীয়েষু,
ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করার জন্য দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুত হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাদের আতিথ্য ভোগ করে ওই কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনো মতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করি নে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম, সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল।
ইতি 
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৬ই মাঘ, ১৩৩২

শেষ পর্যন্ত রমেশচন্দ্র মজুমদারের মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছানুযায়ী মুসলমান নবাব বাড়ি আহসান মঞ্জিলেই আতিথেয়তার ব্যবস্থা হয়। আহসান মঞ্জিল, নর্থব্রুক হল, সদরঘাটে নবাব হাবিবুল্লাহ ও ঢাকার জনগণের বিভিন্ন সংবর্ধনা শেষে রবীন্দ্রনাথ ১০ ফেব্রুয়ারি রমেশচন্দ্রের বাড়িতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের আতিথ্য গ্রহণ করেন। এ সময় রবীন্দ্রনাথ কার্জন হলে দুটো বক্তৃতা দেন। ১০ তারিখ সন্ধ্যায় উপস্থাপন করেন প্রথম বক্তৃতা: ‘The Rule of the Giant’। আর ১৩ তারিখে আধুনিক সভ্যতা নিয়ে দ্বিতীয় বক্তৃতা করেন।

কার্জন হলের এই সংবর্ধনা দেবার আগেই ১০ তারিখ বিকালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জানান। সংবর্ধনার উত্তরে রবি বলেন, ‘এই সভাগৃহে প্রবেশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমার ওপর পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। প্রাচীন শাস্ত্রে পড়েছি কৃতী ব্যক্তির উপর পুষ্পবৃষ্টি হয়। এ পুষ্পবৃষ্টি যদি তারই প্রমাণ করে তবে আমি আজ আনন্দিত।’ 
১৩ তারিখ সন্ধ্যায় জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীরা তাকে অভিনন্দন জানান। জগন্নাথ হলের ছাত্ররা তাদের হলের বার্ষিক পত্রিকার জন্য একটি কবিতার আবদারও করেন। ছাত্রদের অনুরোধে তাদের বাসন্তিকা পত্রিকার জন্য ‘বাসন্তিকা’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথ একটা গীতিকবিতা লিখে পাঠিয়ে দেন। এটা সেই কবিতা -

এই কথাটি মনে রেখো,
তোমাদের এই হাসি খেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলেম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।
শুকনো ঘাসে শূন্য বলে, আপন মনে.
আদরে অবহেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলাম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়/...

১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ সমাবর্তনে আসতে পারেননি। তাঁর অনুপস্থিতিতেই এই উপাধি দেওয়া হয়। ওই সমাবর্তনেই স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও সম্মানসূচক ডি লিট দেওয়া হয়।

দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ধর্মকে ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ এর বিরুদ্ধে কীভাবে আর কতভাবে এদেশের মুসলমান সমাজকে ক্ষ্যাপানো যায় তার অন্তহীন একটা চেষ্টা শুরু হয়। রবীন্দ্রসংগীত হারাম বলে আর ইসলামের বিরোধী বলে ফতোয়া দেওয়া হয় সরকারি মহল থেকে। সেই চেষ্টা যে আজও অনেকাংশেই সফল তা সহজেই অনুমেয়। সেসময়ই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে রবি ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘৃণা করতেন। আর প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। আজও যে কুসংস্কার নিয়ে আমরা বেঁচে আছি।
যাইহোক, আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্র ভবন নির্মাণ কাজে হাত দিয়েছে। কিন্তু এই আনন্দ মাটি হয়ে গেছে জগন্নাথ হলের কারণে।

প্রথমত জগন্নাথ হলের সম্পূর্ণ ধারণাটাই বিচ্ছিরি। একটি প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মের ভিত্তিতে কেন ছাত্রদের আলাদা করে দেওয়া হয়েছে - তা বুঝতে পারি না। আগেকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারতো না। এই কালা কানুন একসময় ছিল। সেসব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু জগন্নাথ হলে মুসলিমরা থাকবে না; আর সলিমুল্লাহ হলে হিন্দুরা থাকবে না - এই কালা কানুনগুলো রয়েই গেছে।

দ্বিতীয়ত, জগন্নাথ হলে বরাবরই হিন্দু চরিত্রদের স্থান দেওয়া হয়েছে। যেমন: স্বামী বিবেকানন্দ, গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব প্রমুখ। একটি হিন্দু ছাত্র হলে হিন্দু দার্শনিকের ভাস্কর্য স্থাপন সমস্যা না। কিন্তু যে মানুষটি হিন্দু না, তাকে ধরে এনে হিন্দুদের হলে বসিয়ে দিলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তার উপর হিন্দুয়ানির সিল পড়ে যায়। রবীন্দ্রভবন জগন্নাথ হলের ভিতরে প্রতিষ্ঠা করায় রবীন্দ্রনাথের গায়েও হিন্দুয়ানির সিল পড়ে যাবে। কোন মুসলিম ছাত্র এই হলে বসবাস করতে পারবে না। কেবলমাত্র তার ধর্মবিশ্বাসের কারণে রবীন্দ্রভবনে বাস করতে পারবে না।

কেন ? রবীন্দ্রনাথ কি শুধুই হিন্দুদের ?

এদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের ধারণা যে রবি ঠাকুর হিন্দু ছিলেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন এমন অনেকেও জানেন না যে - উনি ব্রাহ্ম ছিলেন। আর ব্রাহ্মধর্ম আলাদা একটা ধর্ম।

রবীন্দ্রনাথের ১৬০ তম জন্মদিনের এই উজ্জ্বল দিনে আমাদের অনেকটা দায়িত্ব আছে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক ভুল ধারণাগুলো দূর করার। বিদ্বেষগুলো ভেঙে দেওয়ার। আর কেউ স্বীকার করি বা না করি - সারা বাঙলাদেশের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপরই এই দায় সবচেয়ে বেশি।

 

 

৭ই মে ২০২১ তারিখে লিখিত

(ঈষৎ পরিমার্জিত)

 

সা/ই

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত