ইলিশ কি শুধু ভারতেই যায়?
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৩৯ | আপডেট : ১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫২
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা উপলক্ষে অন্যান্য বছরের মতো এবারও প্রতিবেশী ভারতে ইলিশ রফতানি করছে সরকার। ‘টোকেন’ হিসেবে এবছর মাত্র ৪ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ মাছ রফতানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের বাজারে ইলিশের উচ্চমূল্য নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে এ সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করেছেন। অনেকেই আবার প্রশ্ন তুলেছেন, এত পরিমাণ ইলিশ উৎপাদনের পরও চড়া দাম। ভারতের যাচ্ছে খুবই অল্প পরিমাণ ইলিশ। বাংলাদেশ থেকে আর কোনও দেশে কি ইলিশ রফতানি হচ্ছে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের আরও ১০টি দেশে উৎপাদন হয় ইলিশ। এরমধ্যে ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে সামান্য পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) তথ্যমতে, বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৭৫ ভাগই বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। আর বাংলাদেশের জাতীয় এই মাছের অনন্য স্বাদ ও গন্ধ বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের ইলিশের তুলনায় ব্যাপক জনপ্রিয়। দেশের প্রায় ৭ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ইলিশ ধরার সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও প্রায় ২৫ লাখ মানুষ ইলিশের জাল এবং অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরি, বরফ তৈরি, পরিবহন, বিপণন, বিক্রয় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে জড়িত।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯-২০ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার টন। যেটি ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার টনে। বিএফআরআই-র মতে, বর্তমানে ইলিশের সর্বোচ্চ টেকসই ফলন ৭ লাখ ২ হাজার টন। তবে বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রফতানিকারক সমিতি (বিএফএফইএ) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৬ লাখ টন ইলিশ উৎপাদন হয়। সেখান থেকে ৪ থেকে ৫ হাজার টন ইলিশ রফতানি হলে বাজারে তেমন কোনও প্রভাব পড়ে না। বরং ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার সমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, বছরে আমাদের ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ৬ লাখ টনেরও বেশি। সিজনে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়ে। এই হিসাবে রফতানির পরিমাণ তিন দিনে আহরিত ইলিশের চেয়েও কম। কাজেই বাজারে এর কোনও ধরনের প্রভাব পড়বে না।
জানা গেছে, বাংলাদেশে মোহনা থেকে সমুদ্রের ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার উজানে ও উপকূল থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ইলিশ পাওয়া যায়। দিনে ৭০ থেকে ৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া ইলিশ সাগর থেকে যতই নদীর মিষ্টি পানির দিকে আসে, ততই এর শরীর থেকে লবণ খসে যায় এবং এর স্বাদ বাড়ে। বর্তমানে দেশের সমুদ্র, মোহনা ও উপকূলসহ ৩৮টি জেলার ১০০টি নদী-নালায় ইলিশ পাওয়া যায়।
দেশের ছয়টি উপকূলীয় জেলা ইলিশের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। এগুলো হচ্ছে- চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১০০ কিলোমিটার; ভোলা জেলার মদনপুর চর ইলিশা থেকে চর পিয়াল পর্যন্ত সাহাবাজপুর শাখা নদী ৯০ কিলোমিটার; ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী জেলার চর রুস্তম পর্যন্ত তেতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার; পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর পুরো ৪০ কিলোমিটার; শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার মধ্যে ২০ কিলোমিটার এবং বরিশাল জেলার হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও বরিশাল সদর উপজেলার কলাবাদর ও গজারিয়া মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার।
পুষ্টিবিদদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে ১০২০ কিলো জুল (শক্তির একক) শক্তি থাকে। তাতে ১৮ থেকে ২২ গ্রাম চর্বি, ২২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১৪ দশমিক ৪ গ্রাম প্রোটিন, ২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম আয়রন, সামগ্রিক ফ্যাটি অ্যাসিডের ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ ওমেগা-৩ থাকে। ওয়ার্ল্ড ফিশের হিসাবে, ওমেগা-৩ পুষ্টিগুণের দিক থেকে স্যামন মাছের পরই ইলিশের অবস্থান।
পুষ্টিগুণের পাশাপাশি অনন্য স্বাদ ও গন্ধের জন্য বিশ্বব্যাপী ইলিশের জনপ্রিয়তা রয়েছে। প্রায়শই প্রবাসীদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সুপার শপগুলোতে ইলিশ পাওয়ার কথা জানা যায়। অনলাইনে খোঁজ করেও বেশ কয়েকটি শপের ওয়েবসাইটে ইলিশ বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। ইলিশগুলোর বেশিরভাগেরই বর্ণনায় ‘বাংলাদেশের চাঁদপুরের’ বলে উল্লেখ করা। তবে তার নিচেই ‘মিয়ানমার থেকে আমদানি করা’ লেখা।
যুক্তরাষ্ট্রের ডাবলিনভিত্তিক মাছ-মাংস বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘উইগটমিট ফার্মস’। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ২ পাউন্ডের (৯০৭ গ্রাম) একটি ইলিশের দাম দেওয়া আছে ২৫ ডলার। পণ্যের বর্ণনায় ‘ইম্পোর্টেড ফ্রম মিয়ানমার’।
একইরকম বর্ণনা দেওয়া আছে যুক্তরাজ্যের ‘গ্রোসি’ নামে একটি সুপার শপের ওয়েবসাইটে। এখানে ভারতীয় উপমহাদেশের জনপ্রিয় মাছ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মাছ বাংলাদেশে চাঁদপুর জেলা থেকে আসে। এটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় মাছ।’ এই মাছ বিশ্বব্যাপী রফতানি হয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ ধরনের লেখা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের ইলিশ মিয়ানমার হয়ে রফতানির কোনও সুযোগ নেই।
তবে রফতানি আদেশ সংক্রান্ত সরকার সংশ্লিষ্টরা স্পষ্টতই জানিয়েছেন, ভারত ছাড়া অন্য কোনও দেশে ইলিশ রফতানি হয় না। তারা বলছেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে সম্প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসেবে শুধু ভারতে নামমাত্র পরিমাণ ইলিশ রফতানির অনুমতি দেয়, এখানে অন্য কোনও কারণ নেই। এখানে ব্যবসায়িক কোনও মনোভাবও নেই।
সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন অক্টোবরেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা সামনে রেখে এবার ৫ হাজার টন ইলিশের চাহিদার কথা জানিয়েছিল ভারতের কলকাতার ব্যবসায়ীরা। গত ১ সেপ্টেম্বর কলকাতা ফিশ ইমপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন কলকাতায় বাংলাদেশ উপ হাইকমিশনে এ আবেদন করে। গত ৪ সেপ্টেম্বর সেই আবেদনপত্রটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আসে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কলকাতা ফিশ ইমপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ৩ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশের ৭৯টি প্রতিষ্ঠান এই অনুমতি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ৫০ মেট্রিক টন করে ইলিশ রফতানি করতে পারবে।
গত ২ সেপ্টেম্বর বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে। আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত এই অনুমতি কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে ভারতে ইলিশ রফতানি করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
এ বছর আট শর্তে ইলিশ রফতানির অনুমতি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শুল্ক কর্তৃপক্ষ রফতানির অনুমতিপ্রাপ্ত পণ্যের কায়িক পরীক্ষা করবে, প্রতিটি চালান জাহাজীকরণ শেষে রফতানির সব কাগজপত্র বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পাঠাতে হবে। অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি রফতানি করা যাবে না, অনুমতিপত্র কোনোভাবেই হস্তান্তরযোগ্য নয় ও অনুমোদিত রফতানিকারক ছাড়া সাবকন্ট্রাকটিংয়ে মাধ্যমে ইলিশ রফতানি করা যাবে না।
উল্লেখ্য, গতবছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে মোট ৪ হাজার ৬০০ টন ইলিশ ভারতে রফতানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দুই দফায় এ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ১১৫ প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু অনুমতি পেয়েও অনেকেই ইলিশ রফতানি করেনি। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বছর কোন প্রতিষ্ঠান, কী পরিমাণ ইলিশ ভারতে রফতানি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার প্রকৃত ইলিশ রফতানির তথ্য জানতে চায়।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, অনুমতি পাওয়ার পরেও কেনও রফতানি করা হয়নি, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রফতানির পুরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার পর আমরা বুঝতে পারব কারা, কেন অনুমতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত ইলিশ রফতানি করতে পারেননি। এবছর অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা ভালোভাবে যাচাই করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে চলতি বছর ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আগামী ২২ দিন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা কঠোর নজর রাখবেন। আইন অমান্যকারীকে মৎস্য আইনে সাজা দেওয়া হবে। গত ২০ সেপ্টেম্বর ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম।
সৌজন্যে :বাংলা ট্রিবিউন
কা/আ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত