‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’য় লাখো জমায়েত; ঐক্যের দোহাই দিয়ে নারীর অধিকার অস্বীকার করা যাবে না

প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৫, ২০:১৯ | আপডেট : ১৬ মে ২০২৫, ২৩:৩৭

তার নাম প্রীতি চাকমা, ঘর রাঙামাটিতে। শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচিতে শামিল হয়েছিলেন হাইস্কুলে পড়ুয়া বছর চৌদ্দের এই কিশোরী।
বিকাল পৌনে ৩টায় শুরু হওয়া ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচি শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। ওই সময়ের মধ্যে মানিকমিয়া অ্যাভিনিউতে লাখো মানুষ জড়ো হয়। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে অস্থায়ী লাল মঞ্চে গাওয়া হয় টানা প্রতিবাদী গান, প্রতিবাদী নাটিকা, অভিনয়, দলীয় সঙ্গীত।
এক একটি প্রতিবাদ গান, নাটিকা আর সমবেত সঙ্গীত পরিবেশনের সঙ্গে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সিরা মেতে ওঠেন। কণ্ঠে মেলান এক একটি সঙ্গীত। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। তীর হারা ওই ঢেউয়ের সাগর, কারার ওই লৌহ কপাট-সহ জাগরণী গান বেজে উঠছিল মঞ্চ থেকে। ওই সময় হাত উঁচু করে কণ্ঠ মেলাতে থাকে সমবেত মানুষ।
‘সমতার দাবিতে আমরা’ স্লোগানের এই কর্মসূচিতে প্রগতিশীল নারী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিককর্মী, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছেন। বেলা ১টা থেকে বিভিন্ন ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে তাদের এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আসতে দেখা যায়।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির ৬৪ সংগঠনের কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন নারী উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, নারী মুক্তি কেন্দ্র, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, আদিবাসী ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ নারী জোট, নারী সংহতি, ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), তীরন্দাজ, শ্রমিক অধিকার আন্দোলন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রভৃতি।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মূলত নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। পাশাপাশি নারীদের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীপ্ত প্রতিবাদ জানাতে এ কর্মসূচি।
আয়োজন উপলক্ষে ৩১টি স্লোগানের একটি তালিকা করেছেন আয়োজকেরা। স্লোগানগুলোতে নারীর অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা, শ্রমিকের অধিকার, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষেও স্লোগান রাখা হয়েছে।
বিকাল ৫টার দিকে মঞ্চ থেকে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন জুলাই আন্দোলনে শহিদ মামুন মিয়ার স্ত্রী শারমীন আক্তার, জয়ন্তী চাকমা ও সামসীয়ারা জামান। একটি ঘোষণাপত্র তিনটি ভাগে পাঠ করেন।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম কোনোটাই সরল নয়, সমরূপী নয়। জাতীয় ঐক্যের দোহাই দিয়ে নারী বা অন্য কোনো প্রান্তিক গোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা ও সমাজে ন্যায্য অবস্থানের দাবিকে অস্বীকার করা যাবে না। আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, কৃষকের ভূমির অধিকার থেকে শুরু করে পরিবেশগত ন্যায্যতা প্রতিটিই নারী-সংক্রান্ত বিষয় এবং নারীর অধিকার একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের নির্ণায়ক। সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত না করে সবার জন্য মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা যায় না।
এতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার ও ভবিষ্যতের যেকোনো সরকারকে আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই- নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত সংখ্যালঘু, হিজড়া ও লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিচয়ের নাগরিকের রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোনো শর্তাধীন নয়, হতে পারে না। এ মৌলিক বিষয়গুলোকে হুমকির মুখে রাখলে তা হবে অর্ধশতকের নারী আন্দোলন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও ইনসাফের ধারণার পরিপন্থি।
নারী নেত্রীরা বলেন, আমাদের লড়াই শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, ছুটির অধিকার, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ও সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করার লড়াই। আমরা লড়ছি নারীর ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে; আমরা চাই কৃষক হিসেবে তার পূর্ণ স্বীকৃতি। আমরা চাই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও বাসস্থানের অধিকার। চাই যৌন ও প্রজনন ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার, গোপনীয়তার অধিকার, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় বিচারিক প্রক্রিয়ায় নির্ভয়ে অংশ নেওয়ার অধিকার। নিপীড়িত নারীর বিচার পাওয়ার, মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার। আমাদের লক্ষ্য সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও সব অর্থে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। আমরা লডছি প্রতিবন্ধী ও দেশের সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আমাদের লড়াই পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে, বিচারহীনতার বিরুদ্ধে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্বের বিরুদ্ধে।
উল্লেখিত মৌলিক নীতিগুলোর অধিকাংশই নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন উপস্থাপন করেছে। ফলে এ কমিশন বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত এবং কুৎসিত প্রচারাভিযান অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সেই সঙ্গে সরকার গঠিত কমিশনের সদস্যদের ওপর আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, আমাদের সম্মিলিত অধিকারের একেবারে মৌলিক দাবিগুলোকেও ভয়ভীতি ও হুমকির মাধ্যমে দমন করা হবে।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, আমরা দেখছি, ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতি, হুমকি, সংঘবদ্ধ সহিংসতা অবাধে চলছে। আমাদের ন্যায্য দাবিকে দমন করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা জানতে চাই, সরকার কাকে তোষণ করার চেষ্টা করছে? সংখ্যাগরিষ্ঠের যে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও চরমপন্থা দুর্বলকে পিষে মারে এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজের সম্ভাবনাকে ভয় পায়, সেই অংশটিকে? গণতন্ত্র ও সংস্কারের নামে যে প্রহসন কেবল বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়, তাকে? এসব আমরা চলতে দেবো না।
আমরা জানি- অধিকার চেয়ে পাওয়া যায় না, তা আদায় করতে হয় এবং আমরা তা আদায়ে ভয় পাই না।
ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত দাবিগুলো হলো-
অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিশেষত নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঘিরে গুজব ও অপপ্রচার এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
যারা আমাদের সমর্থন চায়- নির্বাচনী অঙ্গীকারের মাধ্যমে হোক বা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোক- তাদের স্পষ্ট করতে হবে নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত ও লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং এসব জনগোষ্ঠীর পূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত মুক্তির বিষয়ে তাদের অবস্থান। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচন থেকে তাদের প্রার্থীদের অন্তত শতকরা ৩৩ ভাগ (ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে) নারী হতে হবে।
নারী ও প্রান্তিক জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।
এছাড়া ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, আমাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা আমরা মেনে নেবো না। আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোকে অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র আমরা প্রতিরোধ করবো। বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে দমনমূলক অস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা আমরা প্রতিরোধ করব। ইতিহাসবিচ্ছিন্ন কূপমণ্ডুকতার মাধ্যমে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে আমরা কিছুতেই সফল হতে দেবো না। আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময় এবং সংবেদনশীল। সেই বিশালতাকে উপেক্ষা করে আমরা গুটি কয়েক মানুষের সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে সার্বজনীন হতে দেবো না। আমরা অধিকার ও ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে দেবো না, মর্যাদা নিয়ে কোনো ধরনের দ্ব্যর্থকতা মেনে নেবো না। আমরা সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারী বিষয়ক অবস্থান নজরদারিতে রাখবো। যে ক্ষমতাকাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, আমরা সেই কাঠামোকে ভাঙবো।
আমরা চুপ করবো না, হুমকির মুখে নত হবো না। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে অটল থাকবো। ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা হাল ছাড়বো না।
এদিকে বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে একটি র্যালী শুরু হয়ে ফার্মগেট হয়ে ঘুরে এসে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টা ৩৭ মিনিটে। কমসূচির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ কোনো একক বক্তব্য রাখেননি। আয়োজকদের কাছ থেকে বলা হয়, এ কর্মসূচি সবার, একক কিংবা কোনো গোষ্ঠি বা সংগঠনের নয়। এজন্য মঞ্চে একক কাউকে বক্তব্য দিতে দেওয়া হয়নি।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত